১
দিনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। ২০৫৭ সালের সতেরোই জানুয়ারী। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রথমবারের মত পরিবেশ বিপ্লবীদের দখলে চলে আসে।
কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারনে সুন্দরবন সম্পূর্ণ বিলীন হবার পর জনগণ সরকার এবং প্রচলিত রাজনীতির উপর আস্থা হারিয়ে ফ্যালে। আর সেই শূন্য স্থানটি পূরণ করে সবুজবাদী বিপ্লবী দল ‘শ্যামলে শ্যামল’।
এই ভূ-জল-খন্ডের সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রতি শতকের ৫৭ সালেই কিছু না কিছু একটা ঘটেছে। ১৬৫৭ সালে মুঘল সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন আর সিংহাসন দখলের রক্তক্ষয়ী সংঘাতে লিপ্ত হয় তার চার ছেলে দারাশিকো, সুজা, আওরঙ্গজেব আর মুরাদ। ১৭৫৭ সালের পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজুদ্দউলাকে পরাজিত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ধুরন্ধর এজেন্ট রবার্ট ক্লাইভ। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশরা নৃশংসভাবে দমন করে সিপাহী বিদ্রোহ, কামানের গোলায় বেঁধে উড়িয়ে দেয় বিদ্রোহ সমর্থকদের। আরও একশ’ বছর পর ১৯৫৭ সালে অপোগণ্ড রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জার চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, স্বৈরাচারী আয়ুব খান তাকে করেন জনজীবন থেকে চির-ত্যাজ্য।
১৬৫৭, ১৭৫৭, ১৮৫৭, ১৯৫৭। ২০৫৭ সালেও যে একটা বড় মাপের ওলটপালট ঘটবে সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু ২০৫৭ আমার কাছে অবিস্মরণীয় ভিন্ন কারনে। ২০৫৭’র নভেম্বরে আমাদের পরিবারে আরম্ভ হয় এক মঙ্গলময় পট পরিবর্তন।
২
আমার বাবা মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রফেসর। ইলেক্ট্রনিক্সেও বাবার ভীষণ আগ্রহ। একসময় আমাদের ষ্টোর রুমটা ছিল বাবার ঘরোয়া ল্যাবরেটরী। বাবা যেহেতু কুরুকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়য়ের কাজ করতেন, ক্ষুদে গবেষণাগারটির নাম দিয়েছিলেন কুরুক্ষেত্র। ছুটির দিনে বাবা কুরুক্ষেত্রে ডুব দিতেন। আমি আগ্রহ ভরে দেখতাম বাবা কী গভীর মনোযোগে রোবট হ্যান্ড দিয়ে সূক্ষ্ম-ড্রোন কিম্বা জৈবযান্ত্রিক মৌমাছি বানাচ্ছেন।
মা যখন কুরুক্ষেত্র উঠিয়ে আলোক-সংবেদী মার্বেলের বাথরুম বানালেন তখন থেকেই আমার মনে হয়েছিল বাবার প্রতি মা’র ভীষণ একটা উদাসীনতা আছে। সেই উদাসীনতা দিন দিন ঘনীভূত হয়ে তিক্ততায় রূপ নিচ্ছে। প্রায়ই মাঝরাতে বাবা-মা’র বিচ্ছিরি তর্কের উৎকট আওয়াজে আমি গভীর ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠতাম। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। তবু বাবাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিতাম, ভাগ্যিস তিনি জানালায় শব্দ-শিকারি কার্বন ন্যানো টিউবের পর্দা ঝুলিয়েছেন। তা না হলে মুহুর্মুহু পঁচাশি ডেসিবেল শব্দসংঘাতে পাড়াপড়শির নৈশ জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যেত।
একটা সময় ছিল যখন মা'র আদর সোহাগ বাবাকে অস্থির অধীর আর বিহ্বল করে ফেলত। ডালপুরি, সিঙ্গারা, ডিমের হালুয়া, শাহী হালিম কিম্বা ভুনা খিচুড়ি নিত্য দিনই আমাদের পাতে পড়ত। কারন এগুলো ছিল বাবার রসনা বিলাস। মা এখন প্রায় সময়ই বাইরে থেকে চিংড়ি মাছের মালাইকারী আর গরুর মাংসের কালাভুনা আনিয়ে খান। মা জানেন চিংড়ি মাছ আর গরুর মাংসে বাবার ভীষণ অ্যালার্জি হয়। যখন পছন্দের কিছু খেতে ইচ্ছে হয়, বাবা আটা, ময়দা, তেল, ডিম আর মাংসের কার্টিজ কিনে থ্রিডি ফুড প্রিন্টারে কোন রকম লো-রিজোলুশন প্রিন্ট করে খেয়ে নেন। বিফ-বার্গার মা'র ক্ষুধার প্রিয় উপাচার। বাবা ঠিকই সপ্তাহে অন্তত দু’দিন হাই-রিজোলুশন বিফ-বার্গার প্রিন্ট করে মা'র জন্য টেবিলে সাজিয়ে রাখেন।
মা যে হঠাৎ এমন রাগী, বিমর্ষ আর বিদ্রূপাত্মক হয়ে গ্যালেন, এর জন্য আমি দায়ী করব খলিল চাচাকে।
বাবা, মা আর খলিল চাচা অ্যান্টি-ম্যাটারের উপর স্নাতক কোর্স অপদার্থ-বিজ্ঞানের ২০৪০ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। থার্ড ইয়ারে থাকতে খলিল চাচার সাথে আমার মা’র বিয়ে কথা চূড়ান্ত হয়। সব ঠিকঠাক, কেনা কাটা চলছে, অনুষ্ঠানের মাত্র মাস খানেক বাকি, খলিল চাচা হুট করে কোথাকার এক সুন্দরী মেয়ে আর মোটা অংকের সরকারী বৃত্তি বাগিয়ে স্কটল্যান্ডে পাড়ি জমান। মা তখন ভীষণ ভেঙ্গে পড়েন। আমার বাবা ছিলেন মা’র গভীর গোপন ভক্ত। মা’র দুঃসময়ে বাবা পাশে এসে দাঁড়ান। মা নাকি সেই সময় একবার টাইটানিয়ামের রশি বাঁধা ড্রোন আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। রশির অন্য প্রান্ত মা’র গলায় ফাঁস দেয়া। বাবা তখন দূর-নিয়ন্ত্রক তরঙ্গে বিঘ্ন ঘটিয়ে ড্রোনটাকে মাটিতে নামিয়ে আনেন। মৃত্যুর কিনারা থেকে ফিরে আসেন আমার ভবিষ্যতের মা। শেষের কবিতার লাবণ্যের মত শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেন তার অন্ধ ভক্ত আমার বাবাকে। ধীরে ধীরে খলিল চাচা ওদের জীবন থেকে রোদে জ্বলা ছবির মত অদৃশ্য হয়ে যান।
প্রায় সতেরো বছর পর খলিল চাচা দেশে ফিরে আসেন। বাবার ডিপার্টমেন্টেই উচ্চতর অপদার্থ বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন। স্কটল্যান্ডে থাকতেই কি সব ব্যারাছ্যারা লেগে খলিল চাচার ডিভোর্স হয়ে গ্যাছে। নিঃসঙ্গ, ভগ্ন-হৃদয় খলিল চাচা ঘন ঘন আমাদের বাসায় আসা যাওয়া আরম্ভ করেন। যে কেউ দেখলে বলবে এই সময়টা মা’র জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন কাল। মা এমন আলো ছড়িয়ে হাসতেন আর প্রাণ খুলে গাইতেন, মনে হতো বাতাসের তরঙ্গে তরঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে এক শুভ্র উজ্জ্বল পালক।
খলিল চাচা আর বাবা তখন একটা গোপন প্রজেক্টের কাজ করছেন। একবার কিসের নমুনা সংগ্রহের জন্য বাবাকে আর খলিল চাচাকে আড়িয়াল খাঁ নদীতে পাঠানো হলো। প্রথম দুদিন সব ঠিকঠাক চলছিল। তৃতীয় দিন হঠাৎ হাইড্রোজেন ফিউয়েল সেলে আগুন লেগে মাঝ নদীতে হোভার বোট দাউ দাউ করে জলে ওঠে। বাবা কোনমতে সাঁতরে তীরে আসেন। আগুন নেভার পর নৌসেনারা হোভার বোটের ভস্মাবশেষ ঘেঁটে খলিল চাচার হাড়গোড় উদ্ধার করে।
খলিল চাচা মারা যাবার পর মা প্রথমে ক’দিন কেমন স্তব্ধ আর আনমনা হয়ে গেলেও ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতা ফিরে পান। বছর খানেক পর খলিল চাচার অপঘাতে মৃত্যুর উপর কুদ্দুস-কমিশনের রিপোর্ট বেরোয়। ঠিক তখন থেকেই মা বাবা’র সাথে আচরণ পাল্টে ফেলেন। বলা নেই কওয়া নেই, বাবার ল্যাবরেটরী ঘরটা উঠিয়ে দ্যান। আমাদের জীবন থেকে শান্তিও উধাও হয়ে যায়।
৩
২০৫৭ সালের সতেরোই নভেম্বর ভর দুপুরে বাবা আর মা'কে একত্রে বেরোতে দেখে আমি ভীষণ অবাক হই। বহুদিন হয়ে গ্যালো খুব দরকার না হলে মা বাবার সাথে কোথাও বেরোন না।
কিছুদিন আগে রক্তহীন অভ্যুত্থানে দেশের ক্ষমতা দখল করেছে পরিবেশ বিপ্লবীরা। এই নিয়ে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রির মালিকরা ভয়ানক অসন্তুষ্ট। যে কোন সময় দানা বাঁধবে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। একবার গৃহযুদ্ধ বাঁধলে মারকুটে রোবট আর শিকারি ড্রোনে ভরে যাবে শহরের আকাশ বাতাস। নূতন সরকার সপ্তাহ দুয়েক সবাইকে বাসায় বসে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। একান্ত জরুরী না হলে কেউ বাইরে বেরুচ্ছে না।
আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি লক্ষ্য করে মা বল্লেন,
'তোর বাবা ধোলাইখালে একটা ডুপ্লেক্স এপার্টমেন্ট কেনার প্রস্তাব পেয়েছে, অফিস থেকে। তুই যাবি দেখতে?'
আমার খুব ইচ্ছে হলো যাই। আবার ভাবলাম, থাক্, ওরা দুজন বরং কিছু সময় একান্তে কাটাক। এভাবে যদি সম্পর্কটার উন্নতি হয়। যে নৈর্ব্যক্তিক বোঝাপড়া নিয়ে এখন জীবন চলছে, তা থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। বললাম,
'না, আমার হোমওয়ার্ক আছে, তোমরা সাবধানে যেও।'
অর্ধ শতাব্দী আগে ধোলাইখাল ছিল গাড়ির কলকব্জা নির্মাণ, মেরামত আর বিক্রীর রমরমা বাজার। ওখানকার প্রথাগত-শিক্ষা বঞ্চিত যন্ত্রবিদরা অনেক শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে প্রায়োগিক কারিগরি বেশীই জানতো। সেই গৌরবোজ্জ্বল সময়ের সূত্র ধরে ধোলাইখাল এখন এশিয়ার সবচেয়ে নামকড়া কোয়ান্টাম ভ্যালী। কোয়ান্টাম কম্পিউটার থেকে শুরু করে সিলিকন কোয়ান্টাম ডট ফ্যাব্রিকেশন, কী হয় না ওখানে? ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি বিজ্ঞানীদের জন্য ওখানে একটা সুউচ্চ-সুনিম্ন আবাসিক ভবন বানানো হয়েছে যার বিশ তলা মাটির উপর আর দশ তলা মাটির নীচে। প্রোথিতযশা বিজ্ঞানী ছাড়া কারোই সে ভবনে অ্যাপার্টমেন্ট কেনার অনুমতি নেই। বাবা যে এই প্রোথিতযশা বিজ্ঞানীদের একজন, এই বিষয়টা মা'কে হয়তো সামান্য দ্রবীভুত করেছে।
বাব আর মা বাড়ি দেখে ফিরে এলেন অনেক রাতে। ততক্ষণে আমি বিছানায়, আধো ঘুমে, আধো জাগরণে।
পরদিন খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে গ্যালো মায়ের আঙ্গুলের কোমল স্পর্শে। মা আমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন। আহা, কতবছর পর! আমি যেন এক হারানো মাকে ফিরে পেলাম।
এতদিন খলিল চাচার মৃত্যুর সাথে মা'র আবেগের ইতিহাস মিলিয়ে কি ভুলটাই না ভেবেছি। মা'র সব রাগ অভিমান আর অবহেলার মুলে হলো একটা নিজের বাড়ি! শেষ পর্যন্ত আমরা তো ওই গৃহকাতর, স্বপ্ন-স্পৃষ্ট ভেতো বাঙালি, না কি?
ভোরবেলা নাস্তার টেবিলে রুটিতে মাখন মাখতে মাখতে বাবা বললেন, 'অ্যাপার্টমেন্টটা তোমার মা'র খুব পছন্দ হয়েছে। আমরা সপ্তাহ দু’একের ভেতর বাসা বদলাচ্ছি'।
৪
মাসখানেক হয়ে গ্যালো আমরা নূতন বাড়িতে এসেছি। এখনো মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গে, কিন্তু সেটা আগের মত বাবা মা'র কুৎসিত ঝগড়ার কর্কশ কোলাহলে না। রাতভর ওদের শোবার ঘর থেকে এমন সব নৈকট্যময় ঘনশ্রুতি ভেসে আসে যে আমার কানের লতি গরম আর বেগুনী হয়ে যায়। আবার ভালোও লাগে এই ভেবে যে পৃথিবীতে প্রেম নামের অদ্ভুত এবং অস্পষ্ট একটা অনুভূতি আজো আছে। সেই অনুভুতির তাড়নায় মানুষ মানুষকে নিওডিমাম চুম্বকের মত তীব্রভাবে কাছে টানে।
সকালে উঠেই মা গোছল সেরে নিজেকে পরিপাটি করে নেন। তারপর রান্না ঘরে চলে যান। সেখান থেকে ভাজা পোড়ার শব্দের ফাঁকে ফাঁকে ভেসে আসে মা'র গুন গুন করে গাওয়া গানের অমৃত । সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সুমনা হক, জেইমস, আয়ুব বাচ্চু, সত্তর আশি বছর আগের এইসব ধ্রুপদী শিল্পীরাই মা’র পছন্দ। বিশেষ করে মা’র মুখে লেগেই থাকে রক্-আচার্য জেমসের সেই গানটা, আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেব, তুনি আমার,আমি তোমার...
বাবা ভোরে বেলার খবর কাগজ কিম্বা হলোগ্রাফিক নিউজ নিয়ে টেবিলে বসেন। কাগজে কিম্বা বাতাসে ভাসমান খবরে চোখ বুলাতে বুলাতে নাস্তা সারেন। তারপর মা'র সাজিয়ে দেয়া লাঞ্চ বক্স নিয়ে কাজে বেরিয়ে যান। পরিতৃপ্ত সুখী মানুষের হাসিটা বাবা যেন চেষ্টা করেও গাম্ভীর্যের আড়ালে লুকোতে পারেন না।
দেখতে দেখতে আমাদের সুখী জীবনের ছয় বছর কেটে গ্যালো। আমরা সৌভাগ্যের সপ্তম বছরে পদার্পণ করলাম।
৫
২০৬৪ সালের শীতের সকাল। আবছায়া-আকাশবিদ্যার অ্যাডজাঙ্কট্ প্রফেসর আকরাম খান হাতে কলমে দেখাচ্ছিলেন কিভাবে বস্তু ঘনীকরণ যন্ত্র দিয়ে কৃষ্ণ গহবর বানাতে হয়। হঠাৎ কোত্থেকে বাবা হন্তদন্ত হয়ে ক্লাসরুমে ঢুকলেন। আমার বুকটা ছ্যাত্ করে উঠলো।
বাবার কথা মত সময় নষ্ট না করেই গাড়িতে উঠে বসলাম। অদূরে অজ্ঞাতে ঘটে যাওয়া ঘটনা ও তার সম্ভাব্য ভয়াবহতা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে লাগলো।
মা ঘন্টাখানেক আগে পাইকারি দরে ইলেক্ট্রন আর ফোটন কেনার জন্য নীলক্ষেত যাচ্ছিলেন । মা’র গাড়ি যখন চাংখারপুলের মোড় অতিক্রম করে জহির রায়হান রোডের দিকে এগুচ্ছিল, ঠিক তখনই ডান দিকে নাজিমুদ্দিন রোড থেকে একটা ফ্যারাডে-কেইজবিহীন লরী মেয়র হানিফ রোডের দিকে ছুটে আসে। দুটো গাড়িই সেলফ ড্রাইভিং, হাইপার সেন্সর-গাইডেড। রাস্তার পাশে সার বাঁধা ইলেক্ট-মেকানিক্সের দোকানের কোন একটা থেকে হঠাৎ অবৈধ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পালসের তুমুল ঝাপটা এসে লরীর নিয়ন্ত্রন-ব্যাবস্থা সম্পূর্ণ বিকল করে দ্যায়। লরী তীব্র বেগে সজোরে ধাক্কা দ্যায় মা'র গাড়ির ডান পাশে।
ওরা বলছে মা'র অবস্থা বিশেষ সুবিধার না। ঘটনাস্থলে যা করা যায়, ডাক্তাররা তা'ই করবে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব ছুটছি চাংখারপুলের অভিমুখে।
বাবা চুপসানো বেলুনের মতন গাড়ির সিটে এলিয়ে আছেন। আমার থম থমে মুখের দিকে নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে বললেন,
'তোর কি মনে পড়ে আমাদের কাঁঠাল বাগানের বাড়িটার কথা'
'হ্যাঁ'
'মনে পড়ে শেষের দিকে তোর মা আমার সাথে কেমন আচরণ করত?'
'হ্যাঁ'
'কেন করত জানিস?'
'নিজের বাড়ির জন্য। মা সবসময় একটা ভালো বাড়িতে থাকতে চাইতো...'
বাবা একটা কষ্টের হাসি দিয়ে বললেন,
'খলিল চাচার কথা তোর মনে আছে?'
'হু...আমি একবার সেটাও ভেবেছিলাম'
'খলিল ফিরে আসার পর সংসারে অনেক ওলটপালট ঘটে যায়। তোর মা আবার খলিলের প্রতি অ্যাট্রাক্টেড হয়ে পড়ে'
আমার অস্বস্তি লাগছিলো। বাবা বললেন,
'আমার আড়ালে এমন সব ব্যাপার হচ্ছিল...আমি সব বুঝেও...তোর মাকে আহত করতে চাইনি'
'তারপর?'
'খলিল আর আমি জ্ঞান-তরী নিয়ে আড়িয়াল খাঁ নদীতে গেলাম। প্রজেক্টের কাজে। দু'দিন ধরে পুরোদমে নমুনা সংগ্রহ চলল। তৃতীয় দিন বিকেলবেলা প্রসঙ্গটা তুললাম। খলিল প্রথমে সব কিছু অস্বীকার করল। তারপর আরেকটু চাপ দিতেই ঝগড়াঝাঁটি, গাইগুই, এটাসেটা। শেষমেশ বলে বসল ও দ্যুতিকে বিয়ে করবে'
এবার আমারই রাগ লাগছে। বললাম,
'তুমি কি করলে?'
'আমি বললাম, আমার জীবদ্দশায় ও যেন দ্যুতির আশপাশ না ঘেঁষে'
'তারপর?'
'হঠাৎ খলিলের চোখমুখ লাল হয়ে গ্যালো। মুখ দিয়ে গাঁজলা বেরনো আরম্ভ করল। ওর নিশ্চয় গোপন নেশাটেশা ছিল...'
বাবা বলে চললো,
'নিরাপত্তার জন্য আমরা একটা হাই এনার্জি লেইজার গান রাখতাম। ও হঠাৎ লোহিত-রশ্মি ছুঁড়ে হাইড্রোজেন ফিউয়েল ট্যাঙ্কে আগুন ধরিয়ে দ্যায়। তারপর দৌড়ে এসে আমাকে জাপ্টে ধরে।'
'তারপর?', আমি উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে পারছি না।
'ও আমাকে ছাড়ছিল না, ওদিকে আগুন ধেয়ে আসছে। আমাদের ধ্বস্তাধস্তি আরম্ভ হয়। হঠাৎ জ্ঞান-তরীর দোতালার পাটাতন হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ে। তার ইমপ্যাক্ট আমাকে ছুঁড়ে ফেলে আড়িয়াল খাঁর গর্ভে'
'কি বলছ এসব বাবা?'
'খলিল জ্ঞান-তরীতেই রয়ে যায়। পরের ঘটনা তো সবাই জানো'
বাবার কথা শেষ হয়নি,
'খলিল নেই। আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড। সংসারে আবার শান্তি ফিরে এলো। কিন্তু সেই শান্তি ছিল পদ্মপাতায় জলের মত ক্ষণস্থায়ী। কুদ্দুস-কমিশনের রিপোর্টে বেরুলো। ধস্তাধস্তির প্রমান মিললো। তোর মা ভাবল খলিলের মৃত্যুর পেছনে আমার হাত আছে। তুই কি জানিস কুরুক্ষেত্রে বসে কত নূতন কুরু-কৌশল আমি উদ্ভাবন করেছি? তোর মা সেই কুরুক্ষেত্র ভেঙ্গে বাথরুম বসাল। দিনরাত ওর মানসিক অত্যাচার আর উপহাসে আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো'
আমি বললাম,
'বাবা, সেটা কিন্তু সাময়িক। মা তো বাড়ি কেনার পর আবার আগের মত হয়ে গ্যালো'
বাবা আমার কথা শেষ না করতে দিয়েই পাগলের মত হাসতে লাগলো। তারপর বললো,
'নিকোলা টেসলার নাম শুনেছিস?'
'হুম'
'টেসলা স্কেলার বিম সম্পর্কে লিখেছেন কিন্তু বানিয়ে যেতে পারেননি। আমি পেরেছি'
'বাবা তুমি এই সময় এই কথা বলছ কেন?'
'ইউ নিড টু নো। যেদিন তোর মাকে নিয়ে নূতন বাড়ি দেখতে গেলাম...'
'সেদিন কী?'
'আই ট্রিকড হার ইন্টু গোয়িং দেয়ার। স্কেলার গান কত শক্তিশালী তুই জানিস? ও গোছলের জন্য শাওয়ার কেবিনেটে ঢুকলো...ওখানে শাওয়ার হেড ছিল না...ওটা ছিল স্কেলার রেডিয়েশন গান। থ্রি গিগা জুল্স্ অফ এনার্জি অ্যাট ওয়ান গো। ও চক্ষের নিমেষে বাষ্প হয়ে গ্যালো... শি ওয়াজ টার্ন্ড্ ইন্টু গ্যাস। দেন আই আয়োনাইজ্ড্ দি গ্যাস। তুমি জানো গ্যাস আয়োনাইজ করলে কী হয়?'
'প্লাজমা হয় বাবা...কিন্ত এসব কী বলছ তুমি?'
'তোর মা'র ব্রেইন ওয়েভের পজিটিভ ফ্রিকোয়েন্সি, আরটিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স, নিও-রোবটিক্স আর শেইপ ফরমিং মেমরি ম্যাটেরিয়াল... আমি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নূতন দ্যুতিকে বানিয়েছি। একেবারে নিখুঁত নির্মল দ্যুতি, যেমনটি চেয়েছি সমস্ত জীবন । অ্যান্ড শি ওয়াজ ইওর মাদার ফর লাস্ট সিক্স ইয়ার্স। পুরনো দ্যুতি প্লাজমা আলোর ঝলকানি দিয়ে হারিয়ে গ্যাছে… সেই প্রথম বাড়ি দেখার দিন। আর এখন আমার নিজের হাতে গড়া দ্যুতি...'
বাবার চোখ দিয়ে টপ্ টপ করে পানি পড়ছে।
গাড়ি ততক্ষণে চাংখারপুল পৌঁছেছে। দূর থেকে মা'র মেরুন রঙের গাড়ির ধোঁয়া-দীর্ণ ঝাপসা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। আমি গাড়ির দরজা খুলে পাগলের মত ছুটে গেলাম সেই দুঃস্বপ্নের দিকে।
মা’র গাড়ির ডানদিকটা কাগজের দলার মত কুঁকড়ে গ্যাছে। সমস্ত সড়ক জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট ছোট কলকব্জা, লোহার টুকরো আর কার্বন ফাইবার প্লেইট। কতগুলো কোয়ান্টাম সার্কিট থেকে এখনো কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ছে সূক্ষ্ম বেগুনী ধোঁয়া । একটা নিওডিমাম মোটর, ন্যানো ফোটোভোল্টেক লাগানো, এখনো বন বন করে ঘুরছে। ভেচকে যাওয়া মেমোরি ম্যাটেরিয়ালের মুখায়বটি আকৃতি ফিরে পাবার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।
এই ঘূর্ণায়মান মোটর, এই কার্বন জালি, এই জট পাকানো ক্যাডমিয়ামের তার, এই কি আমার মা?